মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের কাজের চার বছর পার হলেও বিএসএফের বাধা, জমি অধিগ্রহণ ও অর্থ সংকট জটিলতায় কাজ হয়েছে মাত্র ৫০ শতাংশ। ২০২১ সালে শুরু হওয়া এ প্রকল্পের কাজ যথাসময়ে শেষ না হওয়ায় এ বছরও বর্ষা মৌসুমে ফের বন্যার আশঙ্কা করছেন নদী তীরবর্তী ৪টি ইউনিয়নের লক্ষাধিক মানুষ।
জানা গেছে, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ কর্তৃক বাধার কারণে উপজেলার সীমান্তবর্তী শরীফপুর ইউনিয়নে মনু নদী প্রতিরক্ষা বাঁধের চারটি স্থান ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নের একটি স্থানে কাজ শুরু হয়নি। বাংলাদেশ অংশে কাজ না হলেও ভারতের অংশে দিব্যি কাজ চলছে বিএসএফের উপস্থিতিতে। এ নিয়ে স্থানীয় সীমান্ত এলাকায় বাংলাদেশিদের মধ্যে চরম ক্ষোভ বিরাজ করছে। এর আগে বিষয়টি নিয়ে স্থানীয়রা একাধিকবার মানববন্ধন করে স্মারকলিপি জমা দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।
আসছে বর্ষা মৌসুমের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে মৌলভীবাজার জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে জেলা উন্নয়ন সভায় মনু নদীর কাজ দ্রæত সম্পন্ন করতে আলোচনা হয়। এর প্রেক্ষিতে গত সোমবার দিনব্যাপী মনু নদীর চলমান বিভিন্ন বাঁধের কাজ পরিদর্শন করে দ্রæত সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালেদ বিন অলিদ ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন। এসময় পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী ছাড়াও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র জানায়, মনু নদীর ভয়াবহ বন্যা আর ভাঙন থেকে মৌলভীবাজার জেলা সদর, রাজনগর ও কুলাউড়া উপজেলাকে মুক্ত রাখতে ২০২০ সালের ২১ জুন ৯৯৬ কোটি ২৮ লাখ টাকার এই বৃহৎ প্রকল্পটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় অনুমোদন হয়। এরপর বিভিন্ন সময়ে দরপত্র আহŸান করা হয় কাজের জন্য। এ প্রকল্পে কুলাউড়া উপজেলায় মোট ২৮টি প্যাকেজের কাজ রয়েছে। যার মোট চুক্তিমূল্য ৩০৭ কোটি টাকা। ২৮টি প্যাকেজের মধ্যে স্থায়ী তীর প্রতিরক্ষামূলক কাজের ২০টি, চর অপসারণ কাজের ৪টি এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ পুনরাকৃতিকরণ কাজের ৪টি প্যাকেজ রয়েছে। প্রকল্পের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত কুলাউড়া উপজেলায় কাজের সার্বিক অগ্রগতি ৫০ শতাংশ। সীমান্তবর্তী কুলাউড়ার শরীফপুর ইউনিয়নের দত্তগ্রাম, নিশ্চিন্তপুর, তেলিবিল ও বাগজুরসহ মোট ৪টি স্থানে মোট ২ কিলোমিটার ২০০ মিটার অংশে স্থায়ী নদী তীর সংরক্ষণের কাজ রয়েছে। কাজের চুক্তিমূল্য প্রায় ৪৫ কোটি টাকা। ২০২১ সালে ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স হাসান অ্যান্ড ব্রাদার্স বাঁধ মেরামত ও তীর সংরক্ষণের কাজটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিসি বøক ও জিও ব্যাগ তৈরির কাজ সম্পন্ন করে রাখে। কিন্তু ৪টি স্থানে ২০২৩ সালের ১৩ জানুয়ারি থেকে বিএসএফের বাধার কারণে কাজ সম্পূর্ণ বন্ধ রয়েছে।
সরেজমিনে পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শিকড়িয়া বাঁধ এলাকায় দেখা যায়, ২০২৪ সালের বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় ১০০ ফুট ভাঙনের কাজ এখনও শুরু হয়নি বিএসএফের বাধায়। কিন্তু সীমান্তের ওপারে ভারতের মাগুরউলি, দেবীপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় কাটাতার ঘেঁষে বাঁধে বিএসএফের উপস্থিতিতে কাজ চলছে জোরেশোরে। দেখা যায়, বড় বড় লরিতে করে মাটি ফেলে বাঁধ উঁচু করা হচ্ছে।
এসময় স্থানীয় বাসিন্দা ফয়জুল হক, মখলিছ মিয়া ও আতিক মিয়া বলেন, ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ভয়াবহ বন্যায় উপজেলার টিলাগাঁও ইউনিয়নহ আশপাশের কয়েকটি ইউনিয়নের অর্ধশতাধিক গ্রামের কয়েক শতাধিক মানুষের ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং হাজার হাজার একর ফসলি জমি নদীর পানিতে তলিয়ে যায়। এর আগেও ২০১৮ সালের বন্যায় উপজেলার টিলাগাঁও, হাজীপুর, শরীফপুর ও পৃথিমপাশা ইউনিয়নে অর্ধশতাধিক গ্রামের মানুষের ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বর্ষা মৌসুমে নদীতে পানি বাড়লে প্রতিরক্ষা বাঁধ, নদী আর গ্রাম কোনটির কোনো অস্তিত্ব থাকে না। সেই সঙ্গে এই ইউনিয়নগুলোর বানভাসী লোকজন প্রতিটি মুহ‚র্তে বন্যার আতঙ্কে দিন কাটান।
তারা আরও বলেন, বিএসএফের বাধায় বাংলাদেশ অংশে কাজ বন্ধ হলেও ভারতীয় অংশে ঠিকই কাজ চলছে। দ্রুত প্রশাসনিক জটিলতা নিরসন করে যদি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বাঁধের কাজ বাস্তবায়ন না করা যায়, তাহলে আবারও নদী ভাঙনের শিকার হতে পারেন মনুপাড়ের মানুষ।
সরেজমিনে হাজীপুর ইউনিয়নের মন্দিরা এলাকায় গেলে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান রাব্বানী কনস্ট্রাকশনের ম্যানেজার রুবেল আহমদ বলেন, মন্দিরা এলাকায় ৯০ শতাংশ কাজ শেষ। কিন্তু সময়মতো কাজের বিল না পাওয়ায় আমরা হতাশ। এদিকে প্রকল্প এলাকায় কয়েকটি ঘর পুনর্বাসন না করায় পুরো কাজ শেষ করতে বিলম্ব হচ্ছে।
মানুষের দুর্ভোগের কথা চিন্তা করে দ্রæত কাজ শেষ করার জোর দাবি জানিয়েছেন পৃথিমপাশা ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও নদী রক্ষা আন্দোলনের নেতা আব্দুল লতিফ। তিনি বলেন, এ অঞ্চলের মানুষের দুঃখের নাম হলো খরস্রোতা মনু নদী। যখনই নদীতে পানি বাড়ে, তখনই এই নদীটির পৃথিমপাশা, টিলাগাঁও, হাজীপুর ও শরীফপুর ইউনিয়ন অংশে ভাঙন দেখা দেয়। বন্যা হলে হাজার হাজার মানুষের ঘরবাড়ি ও ফসলি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাংলাদেশের ৫টি সীমান্তবর্তী স্থানে কাজ বন্ধ থাকলেও ভারতের অংশে বিএসএফের উপস্থিতিতে বাঁধের কাজ চলছে। এখন যদি বাংলাদেশ অংশে কাজ না করা হয়, তাহলে ভারতীয় অংশের কাজ শেষ হয়ে গেলে বিএসএফ আরও কঠোর হবে বলে আশঙ্কা করছি।
মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. খালেদ বিন অলিদ বলেন, কুলাউড়ায় এখন পর্যন্ত ৫০ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। বিএসএফের বাধায় শরীফপুর ইউনিয়নে চারটি স্থানে ১৪০০ মিটার কাজ বন্ধ রয়েছে। ৪টি স্থানের কাজের অনুমতি চেয়ে ২০২৩ সালে যৌথ নদী কমিশন বাংলাদেশ থেকে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন, ভারতের নয়াদিল্লীতে একটি পত্র প্রদান করা হয়। সর্বশেষ মার্চ মাসে কলকাতায় দুই দেশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যায়ে আলোচনা সভা হয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো অনুমোদন আসেনি।
তিনি আরও বলেন, পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শিকড়িয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধের কাজ গত বছর শুরু করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু বিএসএফের বাধায় কাজ শুরু করা যায়নি। যথাসময়ে কাজ শেষ না করলে এ বছরও ফের বন্যার আশঙ্কা রয়েছে। অন্যান্য এলাকায় নদীরক্ষার কাজ দ্রæত শেষ করার জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে তাগিদ দেয়া হয়েছে। যথাসময়ে সরকারের কাছ থেকে বরাদ্দ না পাওয়ায় কাজের মেয়াদ ২০২৬ সালের জুন পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মহিউদ্দিন বলেন, মনু নদীর বৃহৎ প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করতে জেলা উন্নয়ন সভায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। সরেজমিনে পরিদর্শনের মাধ্যমে প্রকল্প এলাকায় যেসকল ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার রয়েছে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। বিএসএফ কর্তৃক কাজে বাধা দেয়ার বিষয়টি সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে।
দৈনিক ইনাতগঞ্জ বার্তা/ ইকবাল
Leave a Reply