হাকালুকি হাওরের বড়লেখা অংশের বিস্তীর্ণ মাঠজুড়ে এখন দোল খাচ্ছে কৃষকের সোনালি স্বপ্ন। বোরো ধানের ঘ্রাণ পুরো এলাকাজুড়ে। হাসি-আনন্দে মাঠে কাজ করছেন কৃষক-কৃষাণিরা। তাদের মাঝে বইছে ধান ঘরে তোলার আনন্দের জোয়ার। প্রযুক্তির ছোঁয়ায় সহজ হয়েছে ধান তোলার অনেক কাজ। তাই কষ্টও কমেছে অনেকটা কৃষকদের। দুঃখ-কষ্ট পেরিয়ে এখন মাঠের পাকা ধানের দোলায় হাসি ফুটছে কৃষকদের মুখে। সোনালী ধান গোলায় তুলতে তাদের কাছে এখন দিনরাত একাকার হয়ে গেছে।
উপজেলা কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, হাকালুকি হাওর অঞ্চলে ৩ হাজার ৬০০ হেক্টর ও হাওর অঞ্চলের বাইরে ২ হাজার হেক্টরসহ মোট ৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে এবার বোরোর আবাদ করা হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে ৭৩ হেক্টর বেশি। ইতোমধ্যে প্রায় ৫৫ ভাগ ধান কর্তন হয়েছে। আরও দশদিনের মধ্যে শতভাগ ধান কাটা সম্পন্ন হবে। ফলন ভালো হওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে এবার।
প্রতি বছরই পুরো বৈশাখজুড়ে হাওরে অন্যরকম এক উৎসব চলে। এটি কৃষকের শ্রমে-ঘামে জমিতে ফলানো সোনার ধান গোলায় তোলার উৎসব। এই উৎসবে কৃষক পরিবারের নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ-শিশু সবাই শামিল হন। এবারও এর ব্যতিক্রম হয়নি।
সরেজমিনে হাওর এলাকায় গিয়ে বেশ কয়েকজন কৃষকের সাথে আলাপকালে জানা যায়, সব সময় যে তারা পুরো ধান গোলায় তুলতে পারেন -এমন না। হাওরের নি¤œাঞ্চল অতিবৃষ্টির কারণে ডুবে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। উজানে ভারী বৃষ্টি হলে পাহাড়ি ঢল নেমে বন্যা দেখা দেয়। এতে ফসল তলিয়ে যায়। তারা ক্ষতিগ্রস্ত হন। তবে গত বছর নির্বিঘ্নে ধান গোলায় তুলেছেন। এর আগের বছর হাওরে কিছুটা ফসলহানি হয়েছিল।
কৃষকরা জানান, এবার আবহাওয়া অনুক‚লে থাকায় এবং সময়মতো চাষাবাদ হওয়ায় ধানের ফলন ভালো হয়েছে। হাওরের পরিশ্রমী কৃষকরা ভোর থেকে শুরু করে দিনভর ব্যস্ত থাকছেন ধান কাটা, মাড়াই ও ঘরে তোলার কাজে। বোরো ধান আবাদকালে স্থানীয় কৃষি কর্মকর্তা সবসময় তাদের পরামর্শ দিয়েছেন।
উপজেলার শ্রীরামপুর গ্রামের কৃষক শ্রীবাস দেব নাথ জানান, এবার হাওরে ১২ বিঘা জমিতে তিনি বোরো আবাদ করেছেন। কৃষি বিভাগ থেকে বিজ ও সার পেয়েছেন, ফলনও ভালো হয়েছে। ধান কাটা শুরু করেছেন তিনি।
একই গ্রামের আরেক কৃষক নুর হোসেন বলেন, পুরোদমে ধান কাটা শুরু হয়েছে। বেশি বৃষ্টি না হওয়ায় সবাই খুশি। ধান শুকিয়ে গোলায় তোলা যাচ্ছে। কিন্তু শ্রমিক সংকট রয়েছে। একসময় হাওরে ধান কাটার জন্য দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে শ্রমিকরা আসতেন। এখন এটা একেবারে কমে গেছে। স্থানীয়ভাবেও শ্রমিক মেলে না। তাই এখন ধান কাটার যন্ত্রের ওপরই ভরসা। হাওরজুড়ে মাত্র ২/৩টি যন্ত্র রয়েছে। তবে সময়মতো পাওয়া যাচ্ছে না। তাই সন্তানদের নিয়ে নিজে নিজে ধান কাটছি। শ্রমিক পেলেও মজুরি বেশি দিতে হয়।
বোরো আবদ করেছেন উপজেলা বর্ণী ইউনিয়নের লেবু মিয়া, আলী হোসেন, লিশন বিশ্বাস ও জয়নুল ইসলাম। তারা বলেন, এবার বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। সময়মতো বৃষ্টি না হওয়ায় কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতি হলেও তা কাটিয়ে উঠতে জমির সম্পূর্ণ ধান কেটে গোলায় তুলতে পারলে কষ্ট স্বার্থক হবে।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মনোয়ার হোসেন বলেন, বোরো ধানের ফলন ভালো হয়েছে। হাওরজুড়ে দুলছে এখন ধানের শীষ। কৃষকের মনে দোলা দিচ্ছে নতুন স্বপ্ন। সারা বছরের জমাট বাধা দুঃখ-কষ্ট পেরিয়ে এখন ফসলি মাঠ দেখে তাদের মুখে হাসি ফুটে ওঠেছে। এখন পর্যন্ত কৃষকরা প্রায় ৫৫ শতাংশ ধান কেটেছেন। নির্বিঘেœ হাওরের ফসল গোলায় তুলতে পারলে এবার ৩৫ হাজার মেট্রিক টন ধান উৎপাদন হবে। এতে কৃষকরা লাভবান হবেন।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা রাশেদুজ্জামান বিন হাফেজ বলেন, প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় বড়লেখার ৩ হাজার ৮০০ প্রান্তিক কৃষককে ৫ কেজি করে উফশী জাতের বোরো ধানের বীজ, ১০ কেজি করে ডিএপি ও এমওপি সার এবং ২ হাজার কৃষকের প্রতিজনকে হাইব্রিড প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় ২ কেজি করে হাইব্রিড বোরো ধানের বীজ দেওয়া হয়। মোট ৫ হাজার ৬০০ হেক্টর জমিতে বোরোর অবাদ করা হয়েছে। প্রতিক‚ল আবহাওয়ার শঙ্কা রয়েছে। তবে এর মধ্যেই কৃষকরা প্রায় ৫৫ ভাগ ধান কেটেছেন। সপ্তাহ-দশ দিনের মধ্যে প্রায় শতভাগ ধান কাটা সম্পন্ন করা যাবে।
দৈনিক ইনাতগঞ্জ বার্তা/ ইকবাল
Leave a Reply